একটি বেসরকারি আবহাওয়া পূর্বাভাস ওয়েবসাইট যা বাংলা ভাষায় আবহাওয়া পূর্বাভাস প্রদান করে থাকে একাধিক আবহাওয়া পূর্বাভাস মডেল, কৃত্রিম ভূ-উপগ্রহ ও রাডার থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে।

বাংলাভাষায় আবহাওয়া বিজ্ঞান চর্চা: জলজ টর্নেডো বা ওয়াটার স্পাউট (Waterspout) এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা

Blog Image
Email : 84k 12k

বাংলাভাষায় আবহাওয়া বিজ্ঞান চর্চা: জলজ টর্নেডো বা ওয়াটার স্পাউট (Waterspout) এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা

মঙ্গলবার (২৮ শে এপ্রিল, ২০২৫) কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারা উপজেলার পদ্মা নদীর উপরে একটি জলজ টর্নেডো সৃষ্টি হয়েছিল দুপুর ৩:৩০ মিনিট এর কাছা-কাছি সময়ে। এর দিকে। আবহাওয়া বিজ্ঞানের ভাষায় জলজ টর্নেডোকে ওয়াটার স্পাউট (Waterspout) বলে। 

গতকাল মঙ্গলবার কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারা উপজেলার পদ্মা নদীর উপর থেকে জ্বলীয় বাষ্প ফানেল বা চুঙা আকৃতি ধারণ করে আকাশের দিকে ওঠে যাওয়ার চমৎকার দৃশ্য দেখতে পাওয়া গেছে যে ভিডিও ইতিমধ্যেই ভাইরাল হয়েছে। এই অতি-প্রাকৃতিক ঘটনাটির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নিম্নরূপ:  

কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারা উপজেলার পদ্মা নদীর উপরে যে অতি-প্রাকৃতিক ঘটনাটি ঘটেছে গতকাল মঙ্গলবার আবহাওয়া পদার্থ বিজ্ঞানের ভাষায় সেই ঘটনাটিকে Waterspout বা জলজ টর্নেডো বলে। আমরা জানি গ্রীষ্মকালে সূর্য থেকে আগত তাপের কারণে খাল-বিল-নদীর পানি বাষ্পায়িত হয়ে জলীয়বাষ্প আকারে আকাশে উড়ে যায়। কোন স্থল কিংবা জলভাগের পৃষ্ঠের তাপমাত্রা তার চার-পাশের স্থান অপেক্ষা অত্যধিক বেশি বেড়ে গেলে ভূ-পৃষ্টের কিংবা জলভাগের উপরের বায়ু প্রচণ্ড গরম হয়ে বায়ুর ঘনত্ব কমে যায় তার চার পাশের বায়ু অপেক্ষা। গরম ও হলাকা বায়ু তখন আকাশের উপরের দিকে উঠে যায় ঠিক যেমন করে গ্রাম বাংলায় কিংবা বৈশাখি উৎসবের দিনে মেলায় কেনা হিলিয়াম কিংবা হাইড্রোজেন বায়ু যুক্ত বেলুন আকাশে উড়ে যায়।  


ছবি: পদ্মা নদীর উপরে জলজ টর্নেডো (Waterspout), ভেড়ামারা, কুষ্টিয়া, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৫ (ছবি কৃতজ্ঞতা: Tofazzal Hossain Shumon)

আপনি প্রশ্ন করতে পারেন প্রতিদিনই তো পানি বাষ্পায়িত হয়ে জলীয়বাষ্প আকারে আকাশে উড়ে যায় কিন্তু প্রতিদিন তো উপরে উল্লেখিত ঘটনা ঘটে না। আপনার প্রশ্ন সঠিক। আজ মৌলভীবাজার জেলার জুড়ী উপজেলার হাকালুকি হাওরে যে ঘটনা ঘটেছে প্রতিদিন ঐ ধরনের ঘটনা দেখা যায় না কারণ ঐ ঘটনা ঘটার জন্য যে প্রাকৃতিক শর্ত পরুন করতে হয় তা সেই রকম পরিবেশ সবসময় দেখতে পাওয়া যায় না। 

জলজ টর্নেডো বা ওয়াটার স্পাউট (Waterspout) এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা

আবারও মূল ঘটনার ব্যাখ্যায় আসি। Waterspout বা জলজ টর্নেডো সৃষ্টির জন্য ৪ টি আবশ্যকীয় শর্ত পূরণ করতে হয় প্রকৃতিকে। ১) বায়ুর উচ্চ তাপমাত্রা ২) বায়ুতে পর্যাপ্ত জ্বলিয় বাষ্পের উপস্থিতি ৩) বায়ু প্রবাহের দিক ভূ-পৃষ্ঠ থেকে বিভিন্ন উচ্চতায় বিভিন্ন দিকে ও ৪)  প্রাকৃতিক বা যান্ত্রিক বলের উপস্থিতি। দৌব্যক্রমে গতকাল মঙ্গলবার, ২৯ শে এপ্রিল ২০২৫ তারিখে মৌলভীবাজার জেলার জুড়ী উপজেলার হাকালুকি হাওরে উপরোক্ত ৪ টি শর্তই উপস্থিত ছিলও। 

যেহেতু গত ১৫ দিন থেকে খুলনা বিভাগের উত্তর দিকের জেলাগুলো এবং রাজশাহি বিভাগের রাজশাহী, পাবনা, চাপাইনবাবগন্জ জেলার উপরে খুবই কম বৃষ্টিপাত হয়েছে তাই বায়ুর তাপমাত্রা অনেক বেশি রয়েছে ঐ সকল জেলার উপরে। গত ১৫ দিন থেকে ঐ এলাকার আকাশ ছিলও প্রায় মেঘ মুক্ত ও ঐ সকল জেলার উপর দিয়ে তাপ প্রবাহ অতিক্রম করেছে। ফলে পদ্মানদীর পানির তাপমাত্রা ছিলও অনেক বেশি। 

গতকাল মঙ্গলবার রাজশাহী বিভাগের উপর বায়ু বিভিন্ন উচ্চতায় বিভিন্ন দিকে প্রবাহিত হচ্ছিল। যেমন ভূ-পৃষ্ট থেকে ১ কিলোমিটার উচ্চতায় বায়ু প্রবাহিত হচ্ছিল দক্ষিণ দিক থেকে। ১ কিলোমিটার থেকে ২ কিলোমিটার উচ্চতায় বায়ু প্রবাহিত হচ্ছিল দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে। ২ থেকে সাড়ে ৩ কিলোমিটার উচ্চতায় বায়ু প্রবাহিত হচ্ছিল পশ্চিম দিক থেকে। ভূ-পৃষ্টে বায়ুচাপ থাকে সর্বোচ্চ ও ভূ-পৃষ্ট থেকে উচ্চতা বৃদ্ধির সাথে-সাথে বায়ু চাপ কমতে থাকে সেই সাথে বায়ুর মধ্যে ঘর্ষণ বলও কমতে থাকে। ফলে ভূ-পৃষ্ট থেকে যত উপরে উঠা যাবে বায়ু তত বেশি গতিতে প্রবাহিত হতে থাকবে। কোন স্থানে যখন বায়ু বিভিন্ন উচ্চতায় বিভিন্ন দিকে প্রবাহিত হয় ও একই সময়ে বিভিন্ন উচ্চতায় বায়ুর গতিবেগ ভিন্ন হয় তখন ঐ স্থানের বায়ুর মধ্যে ঘূর্ণন সৃষ্টি হয়। ঠিক ঐ স্থানের নিচে যদি কোন বিস্তীর্ণ জলভাগ যেমন পদ্মা, যমুনা এর মতো বড় নদী কিংবা হাওর ও বিল থাকে ও সেখানকার পানির তাপমাত্রা প্রচণ্ড গরম থাকে তখন সেই স্থানের পানি দ্রুত বাষ্পায়িত হয়ে আকাশে উড়ে যাওয়ার সময় আকাশের ঘূর্ণি বায়ুর মধ্যে পড়ে ফানেল বা চুঙা আকৃতি ধারণ করে আকাশের দিকে উঠে যায় আবহাওয়া বিজ্ঞানের ভাষায় যে ঘটনাটিকে Waterspout বা জলজ টর্নেডো বলে। 

         

কোন-কোন সময় কোন স্থানের জলভাগের পৃষ্ঠের তাপমাত্রা সেই স্থানের উপরিভাগস্হ বায়ুর তাপমাত্রা অপেক্ষা অনেক বৃদ্ধি পায় (বিশেষ করে বিস্তীর্ণ ও অগভীর জলাশয় যেমন সিলেট ও কিশোরগঞ্জের হাওর এলাকা) তখন জল ভাগের তাপমাত্রা তৎসংলগ্ন স্থল ভাগের চেয়ে প্রচণ্ড ভাবে বৃদ্ধি পেলে সেখানে নিম্নচাপের সৃষ্টি হয় এবং প্রচণ্ড বেগে সেই জল উপরে উঠতে থাকে এই বিষয়টাকে আবহাওয়া পদার্থ বিজ্ঞানে Waterspout  বলে।

একই বিষয়টি স্থল ভাগে সংঘটিত হলে আবহাওয়া বিজ্ঞানের ভাষায় ঐ ঘটনাটিকে বলা হতো টর্নেডো। টর্নেডো খুব শক্তিশালী হলে  যেমন অনেক বড়-বড় বস্তুও আকাশে উড়িয়ে নিয়ে যায় ঠিক একই ভাবে Waterspout জল ভাগ থেকে মাছ-ব্যাঙ সহ অন্যান্য জলজ প্রাণী আকাশে   উঠিয়ে নিয়ে যায়। Waterspout  এর ফলে সৃষ্ট জ্বলীয় বাষ্প যখন অন্য স্হানে বৃষ্টি হিসাবে ভূমিতে পতিত হয় তখন ঐ বৃষ্টির সাথে ঐ সকল মাছ ও ব্যাঙ ভূ-পৃষ্টে পড়ে। 

মাঝে মধ্যে আমরা শুনে থাকি বা পত্রিকায় পড়ে থাকি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বৃষ্টির সাথে মাছ, ব্যাঙ পড়েছে। আমাদের দেশেও একই রকম ঘটনা ঘটলে গ্রাম-বাঙলার মানুষ বলে থাকে প্রকৃতির লিলা-খেলা। এ পর্যন্ত আকাশ থাকে পড়া সবচেয়ে বড় মাছটি ছিল প্রায় ৬ পাউন্ড যা আমাদের প্রতিবেশি দেশ  ভারতের কোন স্হানে রেকর্ড করা হয়েছে বলে বিখ্যাত বিজ্ঞান গবেষনা পত্র "সাইন্স" এর প্রবন্ধে পাওয়া যায়।

আমি আশা করছি কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারা উপজেলার পদ্মা নদীর উপরে যে অতি-প্রাকৃতিক ঘটনাটি ঘটেছে গতকাল মঙ্গলবার পদ্মা নদী থেকে পানির ফানেল বা চুঙ্গা আকৃতি ধারণ করে আকাশের দিকে ওঠেগিয়েছিল তার বৈজ্ঞানিক কারণটি ব্যাখ্যা করতে পেরেছি। 

Related Post